ফারাহ আল-সুলতান: অসমর্থ পরিবেশনায় একজন নারী ব্যবসায়ী

ফারাহ আল-সুলতান: অসমর্থ পরিবেশনায় একজন নারী ব্যবসায়ী

ফারাহ আল-সুলতান: অসমর্থ পরিবেশনায় একজন নারী ব্যবসায়ী


মধ্যপ্রাচ্যের এক প্রথাগত ও রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় জন্ম নেওয়া একজন নারী যখন উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখন সেটিকে কেবল স্বপ্ন বলেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ফারাহ আল-সুলতান সেই ধারনা ভেঙে ইতিহাস গড়েছেন।

প্রচণ্ড সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, নারীর অদৃশ্য সীমারেখা এবং পরিবারিক দমননীতির ভেতর থেকেও তিনি আজ হয়ে উঠেছেন একজন সফল নারী ব্যবসায়ী, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের বহু নারীর অনুপ্রেরণার প্রতীক।




শুরুর গল্প: সীমাবদ্ধতার মধ্যেই স্বপ্নের জন্ম


ফারাহের জন্ম কুয়েতের এক ছোট শহরতলিতে। তার পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল। নারীদের বাইরে যাওয়া, নিজের মতামত প্রকাশ, বা আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্ন দেখা—এই সব কিছুই ছিল অলীক কল্পনা।

ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল পোশাক তৈরি ও ডিজাইনিংয়ে। পুরনো কাপড় দিয়ে নতুন ডিজাইন বানানো, ছোট বোনদের জন্য ড্রেস তৈরি করা—এসব ছিল তার শখ।

তবে সেই শখে বাঁধা পড়ে সমাজের চোখ রাঙানিতে। "মেয়ে হয়ে ব্যবসা?"—এ প্রশ্নে তাকে বারবার থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।



শিক্ষার ভেতর দিয়েই সাহসের সূচনা


প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ আসে কলেজে ভর্তি নিয়ে। অনেক অনুরোধ-উপরোধের পর পরিবারের অনুমতি নিয়ে স্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ভর্তি হন। সেখানেই শুরু হয় তার উদ্যোক্তা হওয়ার প্রস্তুতি।

কলেজের প্রকল্পে একবার তাকে একটি কল্পিত ব্যবসার পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়। তখনই তিনি প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ “হিজাব স্টাইলিং ওনার ব্র্যান্ড” এর কনসেপ্ট তৈরি করেন।

বন্ধুরা প্রশংসা করলেও পরিবার ছিল অনড়। “শুধু পড়াশোনা করো, বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই”—এটাই ছিল তাদের মনোভাব।



বাধা, ঘুরে দাঁড়ানো ও প্রথম উদ্যোগ


একসময় ফারাহ অনলাইনে ছোট একটি ইনস্টাগ্রাম পেজ চালু করেন যেখানে নিজ হাতে তৈরি কিছু হিজাব ও স্কার্ফ ডিজাইন পোস্ট করতে থাকেন। কুয়েত ও সৌদি আরবের কিছু তরুণী সেটি পছন্দ করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে অর্ডারও আসতে শুরু করে।

কিন্তু বড় বাধা আসে পরিবার থেকে।

  • মেয়ের ছবি কেন ইন্টারনেটে?

  • ব্যবসা মানেই বাহিরে যেতে হবে—তোমার জায়গা বাড়িতে

এই সময় একমাত্র সমর্থন পান তার কলেজের এক বান্ধবীর কাছ থেকে, যিনি পার্টনার হয়ে পেছন থেকে সাহায্য করেন—গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগ, ডেলিভারি ও বিজ্ঞাপন চালানো।




👉 এমন অনেক কুসংস্কার ও বাধার ভেতর দিয়েই নারীরা কীভাবে এগিয়ে যায়, তা জানতে পড়ুন এই বাস্তব গল্প:
Dream for Life - ভর্তের গ্রামে কেন পুরুষরা দুই বিয়ে করেন, পেছনে রয়েছে অবিশ্বাস্য কারণ


সফলতার শুরু



২০২০ সালের শুরুতে ফারাহ তার ইনস্টাগ্রাম পেজের ফলোয়ার সংখ্যা ৫০ হাজারে নিয়ে যান। এরপর চালু করেন “Sultanah Styles” নামের একটি ওয়েবসাইট।

এতে হিজাব, অ্যাবায়া, টারবান ও ফ্যাশন এক্সেসরিজের পাশাপাশি থাকত স্টাইলিং পরামর্শ ও ভিডিও টিউটোরিয়াল।

গ্রাহক সন্তুষ্টির জন্য তিনি রাখতেন:

  • ক্যাশ অন ডেলিভারি

  • হিজাবের কাপড় বুঝে বেছে নেওয়ার ভিডিও

  • কালার কনসালটিং চ্যাটবট



সম্মাননা ও স্বীকৃতি


তার ব্যবসায়িক সাফল্যে স্থানীয় কয়েকটি মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০২2 সালে কুয়েতের "Women in Business Excellence" সম্মাননায় ভূষিত হন।

তবে তার সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল সমাজের মনোভাব পরিবর্তন। প্রথমে যারা তাকে বারণ করেছিল, তারাই আজ নিজেদের মেয়েদের তার মতো হওয়ার অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখান।



ফারাহ যা শিখিয়েছেন আমাদের


১. সমাজ নয়, নিজের স্বপ্নে আস্থা রাখো
২. একজন সহমর্মী বন্ধু অনেক বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করতে পারে
৩. অল্প দিয়ে শুরু করো, ধৈর্য ও সততার সঙ্গে এগিয়ে চলো
৪. ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগালে নারীরাও ঘরে বসে বিশ্বজয় করতে পারে



ভবিষ্যতের লক্ষ্য


ফারাহ এখন একটি নারীকেন্দ্রিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস তৈরি করতে চাচ্ছেন, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের তরুণীরা নিজেদের হ্যান্ডমেড প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারবে।

তিনি বিশ্বাস করেন—নারী যদি নিজের অর্থনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে, তবে সে শুধু নিজেরই নয়, একটি সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।



উপসংহার


ফারাহ আল-সুলতান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন—অসমর্থ, রক্ষণশীল ও সীমাবদ্ধ পরিবেশে থেকেও একজন নারী হতে পারেন একজন সফল উদ্যোক্তা। তার সংগ্রাম ও সাফল্য প্রতিটি মেয়েকে বলে—“তুমি পারো, শুধু শুরুটা করো”।


আরও অনুপ্রেরণামূলক গল্প পড়তে ভিজিট করুন:
👉 Dream for Life

Comment